আবির্ভাব :
৭ই জৈষ্ঠ্য, ১৩১৭ (বঙ্গাব্দ)
সোনার গাঁও,ঢাকা


তিরোভাব:
২০শে মাঘ, ১৩৭৯ (বঙ্গাব্দ)

যোগাচার্য সর্বধর্ম সমন্বয়বাদী মহর্ষি প্রেমানন্দ আত্মপ্রকাশ করেন যুগপ্রবর্তক রূপে। তাঁর প্রবর্তিত যুগের নাম অহংগ্রহনাদসাধনার_যুগ , কর্মসন্ন্যাসের যুগ, মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের যুগ। যুগপ্রবর্তক ৭২ ঘন্টায় রাজযৌগিক পন্থায় সমাধি স্ফূরনের ইঙ্গিতই শুধু দেননি, এই যোগ ধারাকে গীতা অবলম্বনে যথা সম্ভব সরলীকৃত সর্বজনগ্রাহ্য করে উপস্থিত করেছেন।

পরিণত বয়সে বর্ত্তমান ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার অন্তর্গত কৃষ্ণনগরের জমিদার শ্রীযুক্ত বাবু সুরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর বড় মেয়ে প্রমীলা রায়চৌধুরীর সাথে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন I বলা বাহুল্য যে, এই সাধ্বী ভগবৎমুখী স্ত্রীই পরবর্তীকালে মা আনন্দময়ীর আসনে বৃত হন I স্ত্রী প্রমীলাদেবীও শিশুকাল থেকে সাধন - ভজন - পূজা - অর্চনা নিয়ে মেতে থাকতেন I বৈবাহিক জীবনে তাঁরা দুটি পুত্রসন্তান লাভ করেন I একজন বাবু প্রণব পোদ্দার এবং অপরজন প্রবীর পোদ্দার I দুজনেই অবিবাহিত ছিলেন এবং গীতা ভারতী মিশনের আদর্শকে আমৃত্যু বহন করে গেছেন I মহাভারতের আদর্শবাহী সাক্ষাৎ উত্তরসূরী হলেন মহর্ষি প্রেমানন্দ I গীতার আদর্শই মহর্ষির জীবনবেদ I তিনি একাধারে গৃহী অপরদিকে সন্ন্যাসী I

মহর্ষি প্রেমানন্দের সাধন জীবনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখি স্বাধীনচেতা শচীন্দ্রমোহন পোদ্দার স্নাতক পাশ করার পরে দেশ মাতৃকার টানে পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কোন সরকারী পদে যোগ দেননি I তিনি তখন নিজেকে জানার জন্য ব্যাকুল I পানাম ও নারায়ণগঞ্জের মাঝামাঝি অবস্থিত কুশিয়ারার ঠাকুর নামে পরিচিত আশ্রমে তিনি যাতায়াত শুরু করেন I ক্রমে সূক্ষ্মে প্রণবের (ওঁ-কার) মাধ্যমে দীক্ষা লাভ করেন I এরপর শুরু হয় সাধনা ; নিজের বাড়ির নির্জন কক্ষে একমাস সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর যোগাভ্যাস করতেন I স্বতঃসিদ্ধ সাধনস্তরে অভিগমনকালে সূক্ষ্মে জ্যোতির্ময় দেহে যাঁদের দীক্ষা দানের পর তিনি হয়ে ছিলেন 'মহর্ষি প্রেমানন্দ ' - তাঁরা হলেন - ভগবান ঋষি অঙ্গিরা, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামীবিবেকানন্দ, ও প্রণবানন্দ, তৈলঙ্গস্বামী প্রমুখ মহামানবগণ I পরবর্তীকালে তিনি হাতিয়ার নিজ জায়গায় ১৩৫৩ সালে বাংলা মাঘী শুক্লা সপ্তমীতে ভাগবত নির্দেশে শুক্লা সপ্তমীতে 'গীতা ভারতী মিশন' প্রতিষ্ঠা করেন I

মহর্ষি বলতে যে চেহারা ও সাজসজ্জা আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে তার সাথে এই মানুষটির বিস্তর তফাৎ I মুখমন্ডল শশ্রুমন্ডিত নয় I নেই আজানুলম্বিত গেরুয়া, বরং আটপৌরে পোশাকের এক বাবু I পরনে সাদা সাধারণ সূতার লুঙ্গী, চুরিদার, গিলে করা পাঞ্জাবী, হাতে নকশাকাটা লাঠি, ব্যাকব্রাশে বিন্যস্ত পরিপাটি চুল I চোখে পুরু ভারী চশমা, কব্জিতে সুদৃশ্য ঘড়ি, মুখে অনিন্দ্যসুন্দর মধুর হাসি I তাঁর প্রতিটি কথা যেন বিদ্যুৎ আভামন্ডিত শুক্তি I প্রতিটি কথনে অনায়াসলবদ্ধ চিন্তার ফল্গু I শ্রোতাকে আকর্ষণ করতো প্রবলভাবে I তাঁর কথা ছিল - I want quality, not quantity. পরমে পূর্ণ নিবেদিত প্রাণ ছিলেন বলেই 'গুরুগিরির' লোভ, মোহ তাঁকে স্পর্শ করেনি I তাঁর কাছে সকল আশ্রিতরা হলেন আধ্যাত্মিক প্রসবিত সন্তান I

আচার্য সন্তানকে অধ্যাত্মজীবনে প্রতিষ্ঠা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি তার পালক, রক্ষক, পরামর্শক ও উপদেশক, আচার্য সন্তানের সাথে দেহবোধে শ্রদ্ধার পাত্র, আত্মবোধে গুরুভাই আর পারমাত্মবোধে অভেদ I

মহর্ষিজীর লক্ষ্য ছিল প্রতিটি ঘর হবে এক একটি আশ্রম I দীব্য জীবন গঠন করে সংসারকে যোগাশ্রমে পরিণত করাই সাধনা I এতে নেমে আসবে অনন্ত শান্তি I কিণ্তু এই শান্তি প্রদান করতে পারেন একমাত্র দক্ষ আচার্য, নিষ্ফলা প্রাণায়াম নয়; স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই হয় প্রাণায়াম I এই সুকৌশল যে আচার্যের করায়ত্ত তিনি প্রকৃত দক্ষ আচার্য I যোগকর্মের এই সুকৌশল মহর্ষি প্রেমানন্দ অর্জন করেছিলেন I তাঁর অহংগ্রহ উপাসনার ধারা আজো বহমান I

সন্তানকে অজপায় মগ্ন করে মনোলয়ের সাধনায় প্রতিষ্ঠা আজো তিনি সূক্ষ্মে দিয়ে চলেছেন I আচার্য তাই সন্তানের আদর্শ, উপাস্য নন I উপাস্য একজনই I তিনি আচার্যেরও উপাস্য I বিশ্বব্রহ্মান্ডের একটি ধ্বনিই অনুভব করতে হয় I ধ্বনির প্রতীক - ওঁ, ওন্, কোন্ বা হু I এই ধ্বনি বা নাদসাধনার মাধ্যমে আলোর জগতে সাধক প্রবেশাধিকার পায় I মহর্ষি প্রেমানন্দের নির্দেশ - নিয়মের বেড়া হিসাবে বা লোকাচার হিসাবে বেদী যদি রাখতেই হয় তাহলে বেদীতে শোভিত থাকবে প্রতীক চিহ্ন, আচার্যের ছবি নয় I আচার্য God like man, God নন, উপাস্য নন I তিনি God এর Commercial use বা বাণিজ্যিক ব্যবহারকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন I

অমৃতের সন্তানরা যাতে অমৃতের স্বাদ পেয়ে ধন্য হন তার জন্য মহর্ষি প্রেমানন্দের প্রেমানন্দময় সাধন জীবন I সেই সাধন জীবনের মূলে ছিল - সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী তাঁর ভাষায় - "গীতা ভারতীর" আদর্শই হল ঐক্যানুভূতির ভিত্তিতে মহামানবের গোষ্ঠী গঠন করা, সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের বাস্তব রূপ দান করা I আমি যা করে যাচ্ছি তা বিগত শতাব্দীর চরম অধ্যাত্মবাদীগণের আরব্ধ কর্মের পরিপূরণ I তাঁদেরই কর্ম বাসনা আমার কর্মে রূপায়িত হচ্ছে মাত্র I অবলুপ্ত রাজযৌগিক প্রণালীতে অধ্যাত্মসাধনার হচ্ছে পুনঃ প্রবর্তন I আমার কর্মধারাকে প্রত্যক্ষ করতে বিশ্বের দরবারে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সত্যান্বেষীদেরকে আজ "গীতা ভারতীতে" আমন্ত্রণ জানাই I